নারীর কাজ সাড়ে তিন গুণ বেশি
![]() |
পুরুষদের তুলনায় সাড়ে তিন গুণ বেশি মজুরিবিহীন কাজ করেন এ দেশের নারীরা। একজন নারী এক সপ্তাহে গড়ে ২৪ ঘণ্টা গৃহস্থালির কাজ করেন, কিন্তু কোনো মজুরি পান না। সেই হিসাবে দিনে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা মজুরিবিহীন কাজ করেন তিনি। এসব কাজের মধ্যে আছে রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া, বাজার-সদাই করা, বাচ্চাদের আদর-যত্ন, স্কুলে আনা-নেওয়া ইত্যাদি। অন্যদিকে একজন পুরুষ সপ্তাহে এমন কাজ করেন মাত্র সাত ঘণ্টা। দিনে করেন গড়ে এক ঘণ্টা।
নারী-পুরুষদের নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তৈরি পরিসংখ্যান-বিষয়ক এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। বিবিএস গতকাল বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটিতে বিবিএস ৫২টি সূচক দিয়ে নারী-পুরুষের তুলনামূলক অবস্থান তুলে ধরেছে। সেখানে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে আছে।
তবে বিবিএস বলছে, যথাযথ তথ্য-উপাত্তের অভাব থাকায় এসব সূচকের মধ্যে ৪৫টিতে নারী-পুরুষের অবস্থান তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। বিবিএসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিবিএস।
বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী গত ২০১৭ সাল শেষে সারা দেশে ৭২ লাখ নারী-পুরুষ মজুরিবিহীন কাজ করতেন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫৪ লাখ। আর ১৮ লাখ পুরুষ এমন কাজ করেন।
গৃহস্থালির কাজে বেশি সময় দেওয়ার কারণে অনেক নারী চাকরি করতে পারেন না। আবার শিশুসন্তান লালন-পালনের জন্যও অনেকে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন কিংবা চাকরি করতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে পুরুষদের তেমন কোনো সমস্যা হয় না। এ ছাড়া রান্নাবান্নাসহ বাসার আনুষঙ্গিক কাজ করতে হয় বলে নারীদের পক্ষে নিয়মিতভাবে কোনো কাজ বা ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব হয় না। কিন্তু গৃহস্থালির কাজের জন্য নারীরা কোনো মজুরি পান না। সামাজিক কারণে মজুরি দেওয়ার প্রচলনও তৈরি হয়নি।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় হিসাবে এই ধরনের মজুরিবিহীন কাজের হিসাব করার সুযোগ আছে। উন্নত দেশে এই ধরনের হিসাব রাখা হয়, যদিও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) সেটা আসে না। তবে জাতীয় হিসাবে তা আলাদা করে রাখা হয়। এটি নারীর মজুরিবিহীন কাজের স্বীকৃতি।
তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, ‘নারীদের অর্থনীতির মূলধারায় আনতে হবে। অর্ধেক জনশক্তিকে কাজে লাগাতে না পারলে আমরা জনমিতির সুবিধা নিতে পারব না। তাই নারীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি যাতায়াত, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো সুবিধা তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া ঘরের কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।’
কয়েক বছর আগে নারীর মজুরিবিহীন কাজের একটি হিসাব করেছে সিপিডি। সেখানে কাজের ছায়া মূল্য ব্যবহার করে সিপিডি প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে দেখিয়েছে যে জাতীয় আয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না এমন কাজ, যা নারীরা করছেন—সব মিলিয়ে এর আনুমানিক বার্ষিক মূল্য (২০১৩-১৪ অর্থবছর) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশের সমপরিমাণ। এ ধরনের হিসাব যোগ হলে জাতীয় উৎপাদনে নারীর অবদান ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশে পৌঁছাবে।
বিবিএসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ, বেকারত্ব, ব্যাংক হিসাব, অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজের সুযোগ, মুঠোফোন-ইন্টারনেট সুবিধা—এসব সূচকে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশ পিছিয়ে আছে।
অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাব খোলা ও মুঠোফোনে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে আছে। যেখানে ৬৪ শতাংশের বেশি পুরুষের একটি ব্যাংক হিসাব আছে কিংবা মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা আছে, সেখানে মাত্র ৪০ শতাংশ নারী এই সুবিধা পান। এর মানে, ৬০ শতাংশ নারীর কোনো ব্যাংক হিসাব খোলা ও আর্থিক লেনদেনের সুযোগ সীমিত। নারীদের মাত্র ৬ শতাংশের মতো ইন্টারনেট সুবিধা পায়। ৯৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মুঠোফোন ব্যবহার করলেও নারীদের ৮৩ শতাংশের মুঠোফোন আছে।
কাজের সুযোগ পাওয়া বা শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা বেশ পিছিয়ে আছেন। যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছর, তাঁদের মধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশ নারী শ্রমবাজারে আছেন। আর পুরুষদের মধ্যে ৫৪ শতাংশই শ্রমবাজারে আছে। এই বয়সের মধ্যে অধিকাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় বলে তাঁরা শ্রমবাজারে যেতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন বিবিএসের কর্মকর্তারা।
বিবিএস বলছে, কর্মজীবী নারীদের মধ্যে সাড়ে ৫৭ শতাংশই অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করেন। আর পুরুষদের মধ্যে এই হার প্রায় ১৬ শতাংশ। অন্যদিকে বেকারত্বের হারও নারীদের মধ্যে বেশি, ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে বেকারত্বের হার মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ। তবে নারীদের মধ্যে যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছর, তাঁদের মধ্যে প্রায় ১৭ শতাংশ বেকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাব অনুযায়ী মজুরি নিয়ে সপ্তাহে এক ঘণ্টার কম কাজ করলে বেকার হিসেবে ধরা হয়।
নারীদের তুলনায় পুরুষেরা বেশি কাজ করেন। তাঁরা সপ্তাহে গড়ে ৫২ ঘণ্টা কাজ করেন। নারীরা করেন সপ্তাহে ৩২ ঘণ্টা।
তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তির সংকট নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে কথা বলা হচ্ছে। এবার বিবিএস নিজেই জানিয়েছে, নারীর পিছিয়ে থাকার কিছু সূচকের তথ্যও পায়নি তারা। যেমন একজন নারী কী পরিমাণ কৃষিজমির মালিক, কর্মজীবী নারী-পুরুষদের মধ্যে কত শতাংশের তিন বছরের কম বয়সী শিশুসন্তান আছে ও এই বয়সী শিশুসন্তানের কতটা আদর-যত্ন পায়—এসবের তথ্য-উপাত্ত বিবিএস পায়নি। এমনকি রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য আছে, সেই চিত্র নির্ধারণ করতে পারেনি বিবিএস।
নারীর কাজ সাড়ে তিন গুণ বেশি
Reviewed by MD SHOJIB KHAN
on
Thursday, May 16, 2019
Rating: 5
Reviewed by MD SHOJIB KHAN
on
Thursday, May 16, 2019
Rating: 5

No comments
hello